ভারতীয় সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য || সংবিধানের মুখ্য বৈশিষ্ট্য গুলো আলোচনা|| Characteristics of Indian Constitution||
সূচনা: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনা করার জন্য ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর একটি গণপরিষদ গঠিত হয়। প্রায় তিন বছর আলাপ- আলোচনার পর খসড়া সংবিধান ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হয় এবং ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি থেকে নতুন সংবিধান কার্যকারী হয়।
ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
ভারতীয় সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
1. বিশ্বের বৃহত্তম ও জটিলতম সংবিধান: বিশ্বের বৃহত্তম ও জটিলতম সংবিধান হল ভারতের সংবিধান। মূল সংবিধানে একটি প্রস্তাবনা, ৩৯৫টি ধারা, বহু উপধারা এবং ৮ টি তপশিল (Schedule) ছিল। বারবার সংবিধান সংশোধনের ফলে বর্তমানে প্রায় ৪৫০টি ধারা, অনেক উপধারা এবং ১২টি তপশিল (Schedule) আছে। বিশ্বের কোনো সংবিধানেই এত ধারা-উপধারা নেই। এই সংবিধান আকৃতিতে বিশ্বের বৃহত্তম হওয়ার ফলে জটিলতমও হয়েছে। সংবিধানে মৌলিক অধিকার, নির্দেশমূলক নীতি, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ থাকায় জটিলতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
2. যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান: ভারতের সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল – ১) লিখিত সংবিধান, ২) কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে ক্ষমতাবণ্টন, ৩) নিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের অস্তিত্ব। তবে সংবিধানে কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ ক্ষমতার উল্লেখ থাকার ফলে ভারতীয় সংবিধানকে এককেন্দ্রিক সংবিধানও বলা হয়। কে. সি. হোয়ার তাই ভারতীয় সংবিধানকে যুক্তরাষ্ট্রপ্রতিম বলে অভিহিত করেছেন।
3. প্রস্তাবনার সংযুক্তি : মার্কিন সংবিধানের অনুকরণে ভারতীয় সংবিধানেও একটি প্রস্তাবনা সংযুক্ত হয়েছে। সংবিধানের অস্পষ্টতা দূরীকরণে প্রস্তাবনার বিশেষ গুরুত্ব আছে। ভারত সংবিধান রচয়িতাগণ প্রস্তাবনার মাধ্যমে সংবিধানের উদ্দেশ্য ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বর্ণনা দিয়েছেন। বর্তমানে প্রস্তাবনায় ভারতবর্ষকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
4. নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি : মূল সংবিধানে সাত প্রকার মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। যথা— ১) সাম্যের অধিকার, ২) স্বাধীনতার অধিকার, ৩) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার, ৪) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, ৫) সংস্কৃতি ও শিক্ষা-বিষয়ক অধিকার, ৬) সম্পত্তির অধিকার, ৭) শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ৪৪তম সংবিধান- সংশোধনে সম্পত্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
5. নির্দেশমূলক নীতির সংযুক্তি: আয়ার্ল্যান্ডের সংবিধানের মতো ভারতীয় সংবিধানের চতুর্থ অংশে (part IV) রাষ্ট্র পরিচালনার কতকগুলি নির্দেশমূলক নীতি সংযুক্ত হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৬-৫১নং ধারাগুলিতে এর উল্লেখ আছে। জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে নীতিগুলি অপরিহার্য। নীতিগুলি হল— ১) কাজের অধিকার, ২) বার্ধক্য ভাতা, বেকারদের সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার, ৩) ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষার প্রবর্তন, ৪) অনগ্রসর সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণ প্রভৃতি।
6. নাগরিকদের কর্তব্য: ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের কর্তব্যের উল্লেখ আছে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ৪২তম সংবিধান সংশোধনে দশটি মৌলিক কর্তব্যের উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- ১) সংবিধান মান্য করা, ২) দেশের ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করা, ৩) জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা, ৪) জাতির মিশ্র সংস্কৃতির গৌরবময় ঐতিহ্য রক্ষা করা ইত্যাদি।
7. সুপ্রিমকোর্টের প্রাধান্য : যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের কথা বলা হয়েছে। ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের ব্যাখ্যা, মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে বিরোধের নিষ্পত্তি প্রভৃতি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
8. এক-নাগরিকত্ব: সংবিধানে ভারতীয় নাগরিকদের এক- নাগরিকত্ব স্বীকৃত হয়েছে। ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্ত হওয়ায় নাগরিকদের কোনো অঙ্গরাজ্যের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। অর্থাৎ ভারতে দ্বি-নাগরিকত্ব বা প্রাদেশিক নাগরিকত্বের অস্তিত্ব নেই।
9. সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার : মূল ভারতীয় সংবিধানের ৩২৫-৩২৬নং ধারায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী-দরিদ্র, স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে ২১ বছর বয়সি প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিককে ভোটাধিকার প্রদান করা হয়। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৬১তম সংবিধান- সংশোধনে ভোটাধিকারের বয়স কমিয়ে ১৮ বছর করা হয়েছে।
10. ধর্মনিরপেক্ষতা: সংবিধানে ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতের কোনো রাষ্ট্রীয় ধর্ম নেই। সেই সঙ্গে ভারতরাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে না। সাধারণভাবে প্রত্যেক নাগরিক তার ধর্মাচরণ ও ধর্মপ্রচার করতে পারে। ড. বি. আর. আম্বেদকরের মতে—“সংসদ নাগরিকের ওপর কোনো ধর্মকে জোর করে চাপিয়ে দেবে না।”
মন্তব্য: ভারতীয় সংবিধান একাধারে যুক্তরাষ্ট্রীয় ও এককেন্দ্রিক, সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয়, রাষ্ট্রপতি শাসিত ও মন্ত্রীপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থার নিদর্শন। ভারতীয় সংবিধানের সকল বৈশিষ্ট্য নিজস্ব নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান থেকে প্রস্তাবনা ও মৌলিক অধিকারগুলি, কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শ, আয়ার্ল্যান্ড ও বার্মা থেকে নির্দেশমূলক নীতিগুলি এবং ইংল্যান্ডের সংবিধান থেকে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার আদর্শ সংযুক্ত হয়েছে।
No comments:
Post a Comment