Breaking


Monday, December 5, 2022

মার্টিন লুথারের অবদান || Martin Luther's Contribution


মার্টিন লুথার
:: মার্টিন লুথার ::

মার্টিন লুথারের অবদান || Martin Luther's Contribution To The Reformation Movement In Europe

সূচনা: 

জার্মানি তথা ইউরোপের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬ খ্রি.)। তিনিই প্রথম খ্রিস্টান চার্চ ও পোপতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক আন্দোলনের সূচনা ঘটান। ষোড়শ শতক থেকে রিফরমেশন' শব্দটি লুথারের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনকে বোঝাতে ব্যবহৃত হতে থাকে। লুথারের ধর্মতত্ত্বের মূল কথা হল ঈশ্বরে অবিচল বিশ্বাসই মুখ্য, চার্চের আচার-আচরণ গৌণ ব্যাপার।



ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের অবদান

1. মার্টিন লুথারের পোপতন্ত্রের বিরোধিতা::-

A. ইনডালজেন্সের বিরোধিতা: ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে যাজক টেটজেল সেন্ট পিটার্স চার্চ সংস্কারের অজুহাতে জার্মানির স্যাক্সনিতে যান। সেখানে তিনি পাপমুক্তির ছাড়পত্র হিসেবে ইনডালজেন্স বা মার্জনাপত্র বিক্রি করতে শুরু করেন। মার্টিন লুথার এই মার্জনাপত্র বিক্রয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।

B. লুথারের ৯৫ থিসিস: লুথার তাঁর 'পঁচানব্বই থিসিস' (Ninety-five theses)-এর মধ্যে দিয়ে পোপতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি ইনডালজেন্স বা মার্জনাপত্র বিক্রয়ের বিরুদ্ধে উইটেনবার্গের কাসেল চার্চের দরজায় তাঁর লিখিত প্রতিবাদপত্র ‘পঁচানব্বই থিসিস' আটকে দেন। তাঁর এই লিখিত প্রতিবাদের মধ্যে দিয়েই কলুষিত পোপতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম জেহাদ ঘোষিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পোপ দশম লিও-র প্রতিনিধি টেটজেল লুথারের এই ৯৫ থিসিসের জবাবে ১০৬টি অ্যান্টিথিসিস বা প্রতিপ্রশ্ন ছাপিয়ে বিক্রি করেন।



2. প্রতিবাদী খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠা: লুথারের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলে খ্রিস্টানগণ দুটি সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে যান। পোপতন্ত্রের অনুগামী বা সমর্থকগণ ক্যাথলিক (Catholic) এবং পোপ বিরুদ্ধকারী তথা লুথারের সমর্থনকারীগণ প্রোটেস্ট্যান্ট (Protestant) বা প্রতিবাদী নামে পরিচিতি পান। জার্মানি এবং তার প্রতিবেশী দেশগুলিতে লুথারের প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিল। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমত Lutheranism বা লুথারবাদ নামেও পরিচিত।


3. অপ্রয়োজনীয় আচার-অনুষ্ঠানের বিরোধিতা: লুথার ক্যাথলিক ধর্মের অধিকাংশ আচার-অনুষ্ঠানকেই অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করতেন। খ্রিস্টের শেষ নৈশভোজ-এর স্মরণে খাদ্যরূপে রুটি ও মদ গ্রহণ রীতি (The Eucharist), খ্রিস্টধর্মের আনুষ্ঠানিক দীক্ষাগ্রহণ ধর্মান্তরিতদের চার্চের পূর্ণাঙ্গ সদস্যরূপে অন্তর্ভুক্তিকরণের অনুষ্ঠান, আনুষ্ঠানিকভাবে যাজকপদে অভিষেক , দোষী ব্যক্তিকে পাদরি কর্তৃক শাস্তি প্রদান এবং অর্থের বিনিময়ে পাপমুক্তি ক্রয় প্রভৃতি অপ্রয়োজনীয় আচার-অনুষ্ঠানের সব সময় বিরোধিতা করেন মার্টিন লুথার।



4. খ্রিস্টধর্মের আদর্শের পুনরুজ্জীবনে প্রচেষ্টা: মার্টিন লুথার খ্রিস্টধর্মাদর্শের পুনরুজ্জীবন ঘটান। লুথার বলেন যে, ভগবান হলেন সর্বশক্তিমান এবং তাঁর ইচ্ছাতেই পৃথিবীতে সবকিছু ঘটে চলেছে। লুথারের মতে, সমস্ত মানুষের ভাগ্যই পূর্বনির্ধারিত এবং যে-কোনো ধনী গরীব সকল মানুষ মঙ্গলময় ঈশ্বরের করুণা বা Gratia লাভের অধিকারী।



5. বাইবেলের অনুবাদে উৎসাহদান: উইলিয়াম ওকামের চিন্তাধারার দ্বারা লুথারের ধর্মীয় ভাবনা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। ইউরোপে এই চিন্তাধারায় বিশ্বাসীরা বলতেন যে, বিশ্বাসই মুক্তি আনবে। জ্ঞান ও বিশ্বাস অর্জনের জন্য শাস্ত্র পড়া প্রয়োজন। এই লক্ষ্যেই নিজ নিজ ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ প্রয়োজন। লুথার এই বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হয়ে বাইবেলের অনুবাদে উৎসাহ জোগান।



6. পোপের কাছে প্রতিবাদ: খ্রিস্টধর্মের এবং চার্চের বিভিন্ন অনাচারের বিরুদ্ধে লুথার বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু প্রতিবাদী বক্তৃতা করেন। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয় ভেবে তিনি রোমে গিয়ে পোপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যাবতীয় ধর্মীয় অনাচার ও দুর্নীতি দূর করার জন্য তিনি পোপকে অনুরোধ জানান। কিন্তু পোপ তাঁর আবেদনে সাড়া দেননি।



7. রাষ্ট্রশক্তির সুদৃঢ়করণ: লুথার বলেন যে, সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অন্যায়ের প্রতিকার করার দায়িত্ব শাসকের। তাই পোপ বা যাজক নয়, শাসক ও তাঁর কর্মচারীরাই হলেন পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি। লুথারের এই মত ইউরোপে রাজতন্ত্র ও জাতীয় রাষ্ট্রগুলিকে শক্তিশালী করে।



8. ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রসার: মার্টিন লুথার সর্বপ্রথম জার্মানিতে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা ঘটান। পরবর্তীকালে এই ধর্মসংস্কার আন্দোলনের রেশ ছড়িয়ে পড়ে মধ্য, পূর্ব এবং পশ্চিম ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে।



9. লিখিত প্রতিবাদ: লুথার অজস্র গ্রন্থ ও পুস্তিকা রচনা করেন। এই গ্রন্থগুলির মধ্যে দিয়ে চার্চতন্ত্রের দুর্নীতির বিরোধিতায় সরব হয়েছিলেন। মার্টিন লুথার এর লেখা একটি প্রবন্ধ ‘বন্ডেজ অব দ্য উইল' । এই প্রবন্ধে তিনি জানান “সকল মানুষ ঈশ্বরের ইচ্ছার দাস, শুধু কাজের দ্বারা সে তার নিজের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে না।” “বাবিলনিয়ান ক্যাপটিভিটি' গ্রন্থে লুথার বলেন যে, জার্মান জাতির চার্চ পোপতন্ত্রের অধীনতা থেকে মুক্ত হতে চায়। ‘রেজোলিউশান' গ্রন্থে লুথার পোপের ক্ষমতাকে অস্বীকার করেন।



মূল্যায়ন: 

একজন দুঃসাহসী ধর্মসংস্কারক হিসেবে মার্টিন লুথার চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনিই প্রথম ষোড়শ শতকে পোপতন্ত্র এবং চার্চতন্ত্রের যাবতীয় অনাচার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হন। গেরহার্ড রিটার তাই বলেছেন যে, “মার্টিন লুথারের প্রচারশক্তি জন্য এই ধর্মবিপ্লব সাফল্যের মুখ দেখে।"

No comments:

Post a Comment